মতিউর রহমান মল্লিক আমার হৃদয়ের মণিকোঠায়
এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর সাথে আমার পরিচয় ঘটে সেই আশির দশকে যখন তিনি প্রথম ঢাকায়
পদার্পণ করেন। সুদর বাগেরহাট থেকে রাজধানীতে এসে প্রথমত কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও
বন্ধু ও ভক্তদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে তিনি দ্রুত আত্মত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলেন।
তাঁকে ঢাকায় আনা হয়েছিল পরিকল্পিতভাবেই। যখন তাঁর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশোন্মুখ হতে শুরু
করেছে তখনই তিনি আমাদের সংগঠনের কাছে এক সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সবার নজর কাড়েন।
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃবৃন্দ নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন তাকে মফস্বলের সীমিতগণ্ডির বাইরে
এনে বৃহত্তর জাতীয় পরিসরে তাঁকে ভূমিকা রাখার সুযোগ দিতে হবে। আমি তখন ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক
সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি। তাঁকে আমার সাথেই সংযুক্ত করে দেয়া হলো। তাঁকে বলা হলো একটি
সংগীতগোষ্ঠী গড়ে তুলতে হবে।
মতিউর রহমান মল্লিক স্বভাবগতভাবে শিশুর
মতো বিনয়ী ছিলেন। নিজেকে সর্বদাই পেছনের দিকে লুকিয়ে রাখতে চাইলেন। এত সুন্দর করে গান,
কবিতা লিখতেন, দরাজ গলায় গাইতেন, কিন্তু এনিয়ে তার মধ্যে কোন অহংকার তো ছিলোই না, বরং
নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। তিনি বাংলাদেশে ইসলামি সংগীতের ক্ষেত্রে এক নতুন জোয়ার সৃষ্টি
করেছিলেন। এর আগে কবি নজরুল ইসলাম ও আবাসউদ্দীন আহমেদ যে কালোত্তীর্ণ ধারা শুরু করেছিলেন
মল্লিক তাঁর জোরে সে ধারাকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। অধিকন্তু তিনি একটা ভিন্ন মাত্রায়
ইসলামি সংগীতের এক নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
মল্লিক ভাই আমাদের সাথে পুরনো ঢাকার
একটি মেসে থাকতেন। একদম সাদামাটা জীবন ছিল তাঁর। লাজুক স্বভাবের মল্লিক জ্যৈষ্ঠদের
সামনে লজ্জা ও বিনয়ে ন্যূজ হয়ে থাকতেন। তিনি সংগীতগোষ্ঠী গড়ে তোলার কাজ শুরু করতে যেয়ে
নিজেকে প্রস্তুত করার কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, সাংস্কৃতিক জগতে
আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে আগে নিজেকে গড়তে হবে। তিনি ভালো করেই জানতেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক
পরিমন্ডলে ঝড়-ঝঞ্ঝা কত বেশি। ঐতিহ্যগত সংগীত চর্চার যে ব্যাকরণ আমাদের দেশে চালু আছে
তাকে উপেক্ষা না করে কিভাবে ইসলামি সংগীতের একটি স্বতন্ত্র প্রবাহ রচনা করা যায় সেটাই
ছিল তার সাধনা। তিনি সংগীতের গ্রামার জানার জন্য অনেকটা গোপনে হারমোনিয়ম হাতে নিয়ে
সংগীত চর্চা শুরু করেন। হারমোনিয়ম দিয়ে ইসলামি সংগীতের সাধনা করতে হবে এমন ধারণার চরম
বিরোধী ছিলেন অনেকেই। এজন্যেই গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হয়েছিল। মল্লিক ভাই ছিলেন প্রচণ্ড
রকম স্পর্শকাতর, আত্মমর্যাদাবোধ ছিল খুবই প্রখর। তাই গোপনীয়তা ছিল একটু বেশি মাত্রায়।
মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন স্বভাবজাত
শিল্পী। তিনি নিজে গান লিখতেন, সুর করতেন এবং গাইতেন। সংগীতচর্চাও ব্যাকরণ শেখার আগে
থেকেই তিনি এগুলো করতেন। ঢাকায় আগমনের পর আমরা তাঁকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে শুরু
করলাম। সত্তর দশকের শেষ দিকে ঢাকায় ইসলামি অনুষ্ঠান বলতে গেলে ছিল না। পঁচাত্তরের পট
পরিবর্তনের পর ইসলামি আন্দোলনের নেতারা ভাবলেন দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে সেকুলারিজমের
বিষবাষ্প থেকে রক্ষার জন্য ইসলামি সংস্কৃতির উজ্জীবন ঘটাতে হবে। এরূপ একটা সময়ে শিল্পী
মতিউর রহমান মল্লিক যেন কাল বৈশাখী ঝড়ের মত ঢাকার আকাশে আবির্ভূত হন। এ সময় মল্লিক
যে অনুষ্ঠানেই গেছেন, তার সুরেণ ঝংকারে আলোড়ন তুলেছেন। তাঁর প্রথম গানের সংকলন
"সুর শিহরণ" আমি সম্পাদনা করি। এতে কবি নজরুল ও ফররুখ আহমদের কয়েকটি গানও
অন্তর্ভুত ছিল। বইটি আমার সংগ্রহে আজ আর নেই।
আমি নিজে সংস্কৃতি কর্মী হলেও নিজে
গান-কবিতার রাজ্যে প্রবেশ করতে পারিনি তবে প্রবন্ধ লিখে প্রশান্তি ও স্বস্তি পেতাম।
আমরা সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে যেয়ে প্রথমেই যে সমস্যা মোকাবিলা করলাম তা হলো: কিভাবে
আগাতে হবে তার কোন দিক-নির্দেশনা পাচ্ছিলাম না। সাধারণ অর্থে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
বলতে নাচ, গান, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদিকে বুঝানো হয়। সুতরাং সব মাধ্যমকে কিভাবে ইসলামিকরণ
করা হবে বা এর বিকল্প কিছু করার সুযোগ আছে কিনা অথবা থাকলে তা ইসলামি শরীয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ
কিনা নানাবিধ বহু প্রশ্নের কোন সদুত্তর আমাদের কাছে ছিল না। এ অবস্থায় আমরা পরীক্ষামূলক
কিছু প্রয়াস শুরু করি। ইসলামি সংগীতকে একটু আকর্ষণীয় ও একটু ব্যতিক্রমী করার জন্য স্থির
স্লাইড তৈরি হলো। প্রধানত প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যের কিছু দৃশ্য এবং বিভিন্ন
ঐতিহাসিক মসজিদ ছিল এর বিষয়বস্তু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাজ শুরু করা হলো। ১৯৭৮
সালের ছাত্রসংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে আমরা আবাসিক হলগুলোতে ইসলামি সংগীত ও স্থির স্লাইড
প্রদর্শনীর আয়োজন করি। সংগীত ও স্লাইড প্রদশর্নীর সাথে থাকতো আবেগময়ী ভাষায় ধারাবিবরণী।
এগুলো লেখার দায়িত্ব ছিল আমার। আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আবাসিক
হলগুলোতেও একই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করি। অনুষ্ঠানগুলোতে অভাবনীয় সাড়া পাই যা আমাদেরকে
সামনে চলতে বিপুলভাবে উৎসাহিত করে।
ঢাকা জেলার ইসলামি ছাত্র আন্দোলরনের
দায়িত্বে ছিলেন রেজাউল করিম শফিক, যিনি কর্মজীবনে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একজন কর্মকর্তা
হিসেবে কর্মরত থাকাকালে পরলোক গমন করেন। শফিক ভাই একদিন জানালেন নারায়নগঞ্জ জেলার মুরাপাড়া
কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে আমরা জয়লাভ করেছি, অভিষেক অনুষ্ঠানে একটি সাংস্কৃতিক কর্মসূচি
থাকতে হবে। তিনি আমাদের সাহায্য চাইলেন। মল্লিক ভাইকে রাজি করানো হলো। আমি আগেই একটা
ধারাবর্ণনা প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। তখনও কাচপুর ব্রীজ নির্মাণ হয়নি। সুতরাং ডেমরা
ফেরীঘাট থেকে নৌকায় করে যেতে হবে মুরাপাড়া। আমরা তিনজন ছাড়াও মল্লিক ভাই তাঁর ৪/৫ জন
সহশিল্পীকে সাথে নিলেন। নৌকাভ্রমণের আনন্দই আলাদা। নৌকায় বসে শুরু হলো আড্ডা। হঠাৎ
করেই মল্লিক ভাই বললেন, মুরাপাড়া কলেজে অনুষ্ঠান তো করবো, কিন্তু আমাদের শিল্পীগোষ্ঠীর
একটা নাম থাকলে ভালো হতো না? আমি তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তাব করলাম, সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী
নামটি কেমন লাগছে? মল্লিক ভাইসহ সবাই একযোগে সমর্থন করলো। আমার ভালো লাগলো নামটি সবার
পছন্দ হওয়ায়। সেই থেকে মল্লিক ভাই সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর পরিচালক। কলেজে পৌঁছে দেখি
শতশত ছাত্র শিক্ষক এবং কিছু অভিভাবক। অনুষ্ঠান শুরু হলো। আমি ধারাবিবরণীতে এবং সাইমুম
শিল্পীগোষ্ঠীর গান মল্লিক ভাইয়ের নেতৃত্বে শুরু হলো। মল্লিক ভাইয়ের সহশিল্পীরা তখনও
পরিপক্কতা অর্জন করেনি। শ্রোতাদের বিশেষ আকৃষ্ট করা গেলো না। অনুষ্ঠান শেষ হলে শ্রোতাদের
নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেলো। তাঁর মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া হলো। তিনি হঠাৎ দৌড়ে
নদীর পাড়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পড়ে দেখতে পাই তাঁর চোখে অশ্রু। আমি ও শফিক ভাই তাকে
সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম। তাঁর যোগ্যতা নিয়ে যে সংশয় নেই, বরং আমাদের সামাজিক
সীমাবদ্ধতায় শ্রোতাদের প্রত্যাশা ছিল গতানুগতিক একথা তাঁকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। এরপর
কিছুদিনের মধ্যে মল্লিক ভাই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন, কারণ তিনি জানতেন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীকে
দাঁড় করানো আর একটি পবিত্র দায়িত্ব, নিছক কোন শখ বা পেশা নয়। এরপর আর তাঁকে সম্ভবত
বিচলিত হতে হয়নি, তিনি এগিয়ে চলেছেন বাধাহীন খরস্রোতা নদীর মতো। তাঁর দ্বিতীয় গানের
বই বের হয় "ঝংকার" নামে। জানি না এটিও কারো সংগ্রহে আছে কিনা।
মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন মুক্ত বিহঙ্গের
মত। মনটা ভালো থাকলে আর প্রাণবন্ত পরিবেশ পেলে তিনি উজ্জ্বলতায় হারিয়ে যেতেন। পাখির
মতো যেন ডানা মেলতেন।
প্রাণ খুলে হাসতেন, রসিকতা করতেন। আমি
তাঁকে আমন্ত্রণ জানালাম কুয়াকাটার কাছে আমার বাড়িতে বেড়াতে যেতে। শিল্পী রাশিদুল হাসান
তপনকে (যিনি বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) নিয়ে মল্লিক ভাই আমার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন।
সাগরপাড়ের গ্রামের ছোটবালিয়াতলী গ্রামটিকে তিনি খুবই পছন্দ করেছিলেন। তিনি পাখির মতো
উড়ে বেরিয়েছেন। ছুঁটে গেছেন ধানক্ষেতের প্রান্তসীমায় ছোট্ট খালের পাড়ে। সেখানে বসে
গান গেয়েছেন, কবিতার পড়ক্তি আওড়িয়েছেন। আরো কত কী। কিছুদিন পড়ে আমি বিয়ে করলাম পাশের
গায়ে। মল্লিক ভাই জানতেন আমি আমার জায়ার প্রতি প্রেম-ভালোবাসায় কতটা কাতর। একদিন বললাম,
আমি তো ভালো কবিতা লিখতে পারি না, আপনি আমার বউয়ের জন্য আমার হয়ে একটা সুন্দর কবিতা
লিখে দিন না। সেদিনই অতি চমৎকার একটা প্রেমের কবিতা লিখে দিলেন। সে কবিতাটি আমার স্ত্রী
সযত্নে ত্রিশটি বছর পাহারা দিয়েছে। বার বার পড়েছে। তিনি জানেন কবিতাটি মল্লিক ভাইয়েরই
রচনা। আমি সেটিকে নিজের বলে চালিয়ে দেইনি। তবে আমার হৃদয়ের গভীরের অনুভূতিগুলো তিনি
এত নিখুঁতভাবে কিভাবে তুলে এনেছেন তা ভেবে আমি বিস্মিত হই। মল্লিক প্রতিভার এক দুর্লভ
প্রকাশ ছিল ঐ কবিতাটি। কবিতাটি নিম্নরূপ।
তুমি
একটি নমনীয় যন্ত্রণা
অথবা
একটি কোমল বিরহের
নাম তুমি
না-
বরং একটি সর্বভুক
ভালোবাসার অক্টোপাস
বিশাল সমুদ্র গর্ভে
আমি এখন
কেমন যেন সসীম হয়ে
আছি।।
সব রকমের শব্দ এবং
সংগীত
আজকে কেবল নতজানু
তোমার শব্দমালার কাছে
না হয় নরম আহবানের
কাছে
একবার বাংলাদেশের
প্রান্তদেশে
একটি বদ্বীপ দেখে।
সৌন্দর্যবোধ আমার
মধ্যে
প্রচণ্ড ক্ষুধার
মতো মনে হয়েছিল
এখন তুমি আমার নাফ
নদীর ক্ষুধার মতো
যেমন টেকনাফে সুনীল
সীমাহীনতা।।
আমি যথন ছাত্র থাকি
কেবল তোমার দৃষ্টিগুলোই
তখন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা
অক্ষরের পর অক্ষর
হাত যখন একটির পর
একটি বই খোঁজে,
তখন তোমার হাত বদলের
শব্দ পেয়ে থমকে দাঁড়াই
আমি এবং তুমি
এই ধরনের যুক্ত অক্ষর
আছে বলেই
ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে
একটি নিরন্তর ইতিহাস
একটি চাঁদ আর একটি
সূর্য যেমন
প্রতিদিন সর্বোত্তম
উপমা
আগে খুব বেশি বুক
কাঁপতো না
যেমন আজকাল কাঁপে
বুকের এই টিপ টিপ
শব্দের মধ্যে
কেবল তোমারই অরন্তদ
উচ্চারণ নাকি
এ এক ধরনের শঙ্কিত
ভালোবাসা
না একাকীত্বের সময়
না কাটার
ধারালো চাবুক।।
মতিউর রহান মল্লিক মূলত একজন বিপ্লবী
ও প্রতিবাদী কবি। তিনি সেই প্রত্রাদিষ্ট আদর্শ বাস্তাবয়নের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি অন্যায়
ও অসত্যের বিরুদ্ধে ছিলেন আমরণ সোচ্চার। তাঁর প্রায় প্রতিটি গান ও কবিতার মধ্যে তাঁর
স্বপ্নের অনুরণন শুনতে পাওয়া যায়। দাও খোদা দাও হেথায় পূর্ণ ইসলামি সমাজ তার প্রত্যাশার
এক বলিষ্ঠ প্রকাশ। অসত্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়াই করেছে। সমাজ সংস্কৃতির
অঙ্গনে যে সকল অনাচার ও অসত্যের সয়লাব তিনি দেখেছেন তার বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিল খরস্রোতা
নদীর মতো, যার মাধ্যমে তিনি কালিমাকে ধুয়ে মুছে সাফ করতে চেয়েছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন
এক বিপ্লবের। নিষণ্ণ পাখির নীড়ে, কাব্যগ্রন্থে তিনি অভিশপ্ত অসুন্দরের প্রতি কবিতায়
লিখেন।
অভিশপ্ত অসুন্দর
তোমার সমস্ত ভয়ংকর
থেকে
আমার হৃদয়কে, আমার
ঘরকে, আমার স্বদেশকে
রেহাই দাও
অথবা তুমি
ফিরে যাও তোমার বীভৎস
উৎসের কুৎসিত ভেতরে।
আবার একই কাব্যগ্রন্থের
তুমি কি এখন কবিতায় তাঁর বিপ্লবী চেতনার প্রকাশ
ঘটেছে এভাবে-
হতাশ হয় না জিহাদের
জঙ্গীরা
হতাশ হয় না কোনো
খাঁটি বিপ্লবী
হতাশ হয় না শহিদের
সঙ্গীরা
বুকে নিয়ে ফেরে ঈমানের
দুন্দুভী
-------------------------------
তোমার সামনে তিতুমীর
আছে
আছেতো খানজাহান
হাজী শরীয়ত আছে আরো
কাছে
আছে শাহজালাল অম্লান
----------------------------
বখতিয়ারের ঘোড়ার
শব্দ ঐ
লোকালয়ে যেনো অবিকল
শোনা যায়
তাই কি আমিও দুই
কান পেতে রই
সতেরো সওয়াব কবে
আসবে দরজায়
--------------------------------
তবে তুমি ছুটে চলো
বেগে আরো বেগে
বন্যার মত দুরন্ত
দুর্বার
চলো তাকবীর জোরে
আরো জোরে হেঁটে
পড়ে থাক পিছে পচা
লাশ মুর্দার।
মল্লিকের কবিতায় ইতিহাস চেতনাও অত্যান্ত
প্রখর, একই সাথে স্বদেশ ও জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্য তাঁর লেখার অন্যতম উপজীব্য। বাগেরহাটের
সন্তান মতিউর রহমান মল্লিকের রক্তে যেমন তিতুমীর, খানজাহান আলীর সংগ্রামী ধারা প্রবহমান
তেমনী হাজী শরীয়তউল্লাহ আর হযরত শাহজালালের বিপ্লবী চেতনাও বহমান ছিল। তিনি একটি সমাজ
বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন, আর সে স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য জীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
তিনি সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সহজেই সনাক্ত করতে পারতেন। সামাজিক সমস্যা ও রাজনীতির
জটিল বিষয়গুলো নিয়েও তিনি ভোজন। তিনি লিখেছেন-
মীর জাফরের পদভারে
দেশ
জর্জরিত,
ক্লাইভ এবং ইষ্ট
ইন্ডিয়া
সব জড়িত
বাংলাদেশের সর্বনাশের
পেছনে আজও, জগৎ শেঠেরা
হয়নিতো শেষ
তাদের কাজও।
স্বাধীনতার চেতনায়
মল্লিক ছিলেন উজ্জীবিত। স্বাধীনতা যাতে বিপন্ন না হয় সেজন্যে তিনি ছিলেন অতন্দ্র প্রহরীর
ন্যায়। তিনি লিখেছেন-
সীমান্তে কাড়ি প্রতিদিন
বিডিআর
সাধারণ লোক? তাও
গাড়ি বর্ডারে
কৃষক-মজুর-গ্রাম্য
নির্বিচারে।
গড়বো না কেনো?
ঐ খুশি করতে কেন
পারবো না?
পারবো না কেন?
পাকওয়ালাদের বারোটা
বাজিয়ে
হানাদারদের পাজরে
ঘা দিয়ে
এইতো সেদিন তোমাদের
হাতে
দিয়েছি যে তুলে পতাকা
স্বাধীনতার।
মল্লিক ছিলেন একজন মানবতাবাদী কবি।
মানুষের দুঃখ-কষ্টে তিনি দারুণভাবে বিগলিত হতেন। তিনি দরদ দিয়ে বিপন্ন মানুষের জন্য
গান গইতেন, কবিতা লিখতেন। দু'হাজার সাত সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রলয়ংকরী সিডর আঘাত
হানলে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। তিনি ছিলেন ঐ অঞ্চলের বাসিন্দা। তিনি
লিখেন-
সিডর দিয়েছ ডর
বিপন্ন অন্তর
সিডর দিয়েছে স্বজন-হারানো
গুমরিত প্রান্তর
দিয়েছে করুণ মৃত্যুর
হাহাকার
দিয়ে গেছে খুলে ভয়াল
সিডর
বেদনায় যত অশ্রুসিক্ত
দ্বার
আর দিয়ে গেছে বুকফাটা
চিৎকার
ধস্ত বিরান বিবর্ণ
সংসার।
মল্লিক ছিলেন একজন নিভৃত দরবেশ। মহান
আল্লাহর দরবারে যিনি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন সব কিছু উজাড় করে। মহামহিমের সৌন্দর্যের
পিপাসায় তিনি ছিলেন কাতর। আমরা তার দরাজ কণ্ঠে শুনতে পাই- তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর
তা হলে না জানি তুমি কত সুন্দর। নবী প্রেমে মল্লিকের গান এক অপরূপ সৃষ্টি। বাংলাদেশের
প্রান্ত হতে সালম জানাই হে রাসুল এত সুন্দর অভিব্যক্তি একমাত্র নজরুলের সাথেই তুলনীয়।
মল্লিকের এক একটি গান ও এক একটি কবিতা
যেন স্বকীয়তায় জ্বলজ্বল করে। তাঁর এসব সৃষ্টি দীর্ঘকাল মানুষের মাঝে টিকে থাকবে। একজন
মানুষ যিনি একাধারে কবিতা ও গান লিখেন, গানের সুর দেন, নিজেই গানের শিল্পী, আবার নিজেই
শিল্প-সংস্কৃতির সংগঠন ও নেতা। অপরদিকে তিনি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনাও করতেন। এরূপ
একজন বহুমুখী প্রতিভার দারুণ অভাব জাতি দীর্ঘকাল অনুভব করবে। তিনি মূলত একটি সাংস্কৃতিক
আন্দোলনের সূচনা করে গেছেন এবং তা যথেষ্ট গতি লাভ করেছে। সারাদেশে এমনকি দেশের বাইরেও
তার আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে গেছে। আমি নিজে দেখেছি আমেরিকার হাইওয়েতে অথবা আরবের মরুভূমির
বুক চিড়ে চলন্ত গাড়িতে মল্লিকের গানের সিডি বাজছে। মল্লিকের গানের ভক্তরা এমনিভাবে
ছড়িয়ে আছে দুনিয়ার সর্বত্র।
মল্লিকের এই অবিস্মরণীয় প্রতিভা বাংলাদেশ
সত্যিই বিরল। নানাবিধ অসঙ্গতিতে ভরা আমাদের সমাজে সত্য ও সুন্দর যেন উঠে দাঁড়াতে পারছে
না। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির জগতেও এক ধরনের সিন্ডিকেট রয়েছে
যারা পারস্পরিক পিঠ চুলকানির চর্চা করেন। এখানে মুখচেনা এক শ্রেনীর ইহজাগতিক কবি সাহিত্যিকদের
জন্য উপরে উঠার সহজ সিঁড়ি রয়েছে। পক্ষান্তরে আল মাহমুদের মতো কালজয়ী কবিরাও হন অপাঙ্ক্তেয়।
মতিউর রহমান মল্লিকের মত প্রতিভা যদি ইহলৌকিকতার পথে হাটতেন তাহলে প্রচারিত প্রচারযন্ত্র
তাকে কোথায় টেনে তুলতো ভাবতে গিয়ে বিস্ময় হতবাক হয়ে যাই।
লেখক: সাবেক সচিব ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আল্লাহ এই নক্ষত্রকে কবুল করুন।
উত্তরমুছুনআল্লাহ এই ক্ষণজন্মা নক্ষত্রের জীবনের সকল কর্ম কবুল করে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নিন, আমিন।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন