ম্লান জোসনার যা কিছু দীপ্ত যা কিছু মলিন | আজিজ হাকিম

 


সকালের প্রথম প্রহর৷ সবে মাত্র ফজরের মুসুল্লিরা বাড়ি ফিরছেন। এরই মাঝে হুইশেল বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। মক্তবের শিক্ষার্থীরা সিপারা হাতে মসজিদে যাচ্ছে। একই রাস্তার চাস্টলের পাশে এপ্রোন পরে বসে আছে এক পাগল। হাসান পাগল। মাটিতে কিছু আঁকা আঁকি করছে৷ হয়তো তার হারিয়ে যাওয়া কোনো স্বপ্নকে খুঁজে ফেরার চেষ্টা করছে। বলছিলাম সাইমুম থিয়েটারের ইউটিউবে সদ্য মুক্তি পাওয়া টেলিছবি- ‘ম্লান জোসনা’র কথা। গল্পের প্রধান চরিত্র এই হাসান পাগলা। তার মুখশ্রী দেখিয়েই টেলিছবির যাত্রা শুরু। আর এই লেখার শুরুতে সাইমুম থিয়েটারকে ধন্যবাদ দিয়ে রাখি, আমাদেরকে একটি টেলিছবি উপহার দেওয়ার জন্য। বেশি বেশি কাজের মাধ্যমেই আমরা থিয়েটারকে পাঠ করতে পারব, শক্তি এবং অনুপ্রেরণা পাবো নতুন নতুন কাজের। আব্দুল্লাহেল কাফি পরিচালিত ১ঘন্টা ২৭ মিনিট দৈর্ঘের টেলিছবিটির গল্প লিখেছেন একে জিলানী এবং চিত্রনাট্য করেছেন তালহা জুবায়ের।

দুই লাইনে যদি টেলিছবির গল্পটা বলি, তাহলে দাঁড়ায়- গরিব মাঝির ছেলে হাসান। মেডিকেলে পড়াশোনা করতে গিয়ে কিছু দুষ্টলোকের পাল্লায় পরে সোশ্যাল মিডিয়ার হ্যারেজমেন্টের স্বীকার হয়। ফলশ্রুতিতে তার বাবা মারা যায় এবং সেই শোকে হাসান পাগল হয়ে যায়৷
গল্প বলার পর যেটা বাদ থাকে, তা হচ্ছে সমালোচনা। সেটা ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক যেকোনোটাই হতে পারে৷ এ ব্যাপারে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। একজন সাধারণ দর্শক বিনোদিত হওয়ার চোখে কন্টেন্ট দেখে। আর সমালোচক তার সমালোচনার চোখ দিয়ে কন্টেন্ট দেখে। আর যেহেতু আমিও একজন নির্মাতা, সেহেতু আমার সমালোচনা সমালোচক এবং নির্মাতা উভয় চোখ দিয়েই হবে এটাই স্বাভাবিক৷ ব্যাপারগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷
নাটক থেকে মোবাইল ব্যবহারের যে নেতিবাচক দিকগুলো দেখানো হয়েছে:
ক) ভার্চুয়াল গেমের আসক্তি
খ) অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে টিকটক ভিডিও নির্মাণ
গ) রাত জেগে চ্যাটিং
ঘ) ভাইরালের নেতিবাচক ইফেক্ট।
চরিত্র রূপায়ন:
ক) প্রধান চরিত্র হাসানের অভিনয় মোটামুটি ভালো ছিল। চেষ্টা করেছেন ভালো করার। দর্শক তাকে গ্রহণ করবেন বলে বিশ্বাস করি।
খ) মাঝির চরিত্র, হাশেমের চরিত্র ঠিকঠাকই মনে হয়েছে।
গ) সবচেয়ে ভালো লেগেছে নাজমুল বিন আশশাবের অভিনয়। অল্প কিছু শট হলেও। যা ছিল দুর্দান্ত।
ঘ) আর পেশাদার অভিনেতা না হয়েও জিলানি ভাইয়ের অভিনয় বাস্তবিক মনে হয়েছে। যেখানে অনেক পেশাদার অভিনেতাদের অভিনয় এখানে ফেক মনে হয়েছে।
ঙ) গড়পড়তা কিছু কাজের জন্য সাথে রাখা প্রয়োজন সেই অর্থে সাথে রাখা হয়েছে এমন চরিত্রগুলো সুপারফ্লপ করেছে৷ বিশেষ করে শিশুচরিত্রগুলো। মোবাইলে আসক্ত ছেলের অভিনয়৷ ললিপপ কিনতে যাওয়া কিশোর৷
চ) মোবাইলে গেম খেলার ধরণগুলোর সব বাস্তবিক মনে হয়নি। এতো লাফালাফি হয়তো হাস্যরসের জন্য করা হয়েছে৷ কিন্তু এতে বাস্তবতা অবহেলিত হয়েছে৷
ছ) আর কিছু প্রফেশনাল অভিনেতার চরিত্র ও অভিনয় একদমই খাপছাড়া লেগেছে। মঞ্চে এমন অভিনয় মানায় টিভি নাটকে না৷
জ) কিছু কিছু চরিত্রের সাথে গল্প এবং গল্পের প্রধানচরিত্রের সম্পর্ক কী? তা সহজে বোঝা যায়নি।
চরিত্র নির্মাণ এবং ডাইলগ:
ক) ললিপপ চায়-ই নাই৷ দোকানদার বলে উঠলো ললিপপ নিবা? যেন অই কিশোর ডাইলগ দিতে পারতো না, তাই দোকান্দারকে দিয়ে চালিয়ে নেওয়া হয়েছে।
খ) আমার ছেলে মোবাইলে আসক্ত। এই নিয়ে চোখে সমস্যা। হঠাৎ বলে উঠলেন- আপনি কী করেন? আমি মানুষকে গান গেয়ে আল্লাহর পথে ডাকি৷ তৎক্ষণাৎ গান শুরু হইলো। ব্যাপারটা হয় নাই৷ মেলে নাই। তাড়াহুড়ো হয়ে গেছে।
গ) ❝আমাকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না❞ এইসব ডাইলগ না দিয়েও পারা যেতো৷
ঘ) ❝শুনলাম মকবুল চাচারে নাকি কালকে ধরছে। চাচা যখন কইছে ওনাকি ওর বাপের মত। হে তখন ছাইড়া দিছে❞ এই ডাইলগের শব্দচয়নটা যায় নাই। চাচার সাথে ‘ও যখন’ যায় না। গুরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট।
আবার মকবুল চাচা অইখানে হাজিরই আছেন। তার সামনেই তার গল্প বলা হচ্ছে৷
ঙ) ক্যাম্পেইনের নোমান সাহেব আরো একটু বয়স্ক হতে পারতেন। তার আলোচনা শুনে টিকটকাররাও মাথা নাড়ায়। বাস্তবে তো এমন হওয়া অতটা সোজা না। এমন ক্যাম্পেইনে বরং তারা আসারই কথা না।
গল্পের অসামঞ্জস্যতা:
ক) মদের বোতল একটি হাতে আরেকটা কোলের কাছে। আর কয়েকটি ইয়াবা ট্যাবলেট। এমন একটি ছবি ভাইরাল করার কারণেই পুলিশ ধরে নিয়ে যায়৷ কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। ব্যাপারটা মেনে নেওয়া কঠিন হয়েছে। আদতে সিস্টেমটা এতো সোজা না মনে হয়।
খ) জেল থেকে ছাড়া পেলো হাসান৷ এই সময়ে এসে এইও কী সম্ভব? বাবা মারা গেছে সংবাদ পাবে না? কেউ জানাবে না। জেল থেকে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে জানাজায় আসতে পারবে না৷ ধরলাম তার কেউ নেই। সেইজন্যে সম্ভব হয় নাই। তাহলে হাশেম সাহেব কী করলেন? হাশেম ছেলের পড়াশোনার টাকা দিয়েছেন, গ্রামের সচেতনতায় কাজ করেন। আর এই ছোট্ট কাজটি করেন নাই৷ সেটা যদি নাই করে থাকেন। তাহলে হাসানের জামিন করিয়েছে কে?
গ) আবার রাস্তায় একজন বললো নিজেরে খাইছে বাপেরেও খাইছে। এখানেই হাসানের বুঝে যাওয়ার কথা যে বাবা মারা গেছে৷ এরপরেও সুবোধ বালকের মত বাড়ির দিকে কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই চলে গেল। আর বাড়ির গেটে তালা দেখার পর একজন বলল যে তোর বাবা মারা গেছে পিছনে তার কবর।
নির্মাণ:
ক) বর্তমান দোকানে যে কয়টা ব্রাশ ছিল। ফ্লাসব্যাকে গিয়ে অতীতেও দোকানে সেই একই কোম্পানির সেই কয়েকটা ব্রাশই ছিল। কোনো বেচাবিক্রি নাই। এই ছোট্ট একটি বিষয় দেখেই বলা যায় টেলিছবির শিল্প নির্দেশনা পরিকল্পিত না।
খ) মোবাইল গানের চিত্রায়নে নৌকায় যেভাবে বসেছেন সবাই। বাস্তবে এইভাবে নৌকায় কেউ বসে না। একদিক করা হয়েছে ক্যামেরার ফ্রেমিং এর জন্য। এটি দর্শক হিসেবে বোঝা যায়। আর গানের মাঝে মাঝে বিভিন্ন দৃশ্য দেখানো হয়েছে। যেগুলো মিউজিক ভিডিওতে করা হয়। কিন্তু এটা তো শুধু মিউজিক ভিডিও না, টেলিছবি।
গ) ❝এতো বড় একটা কাজ করবো আর সেখানে আমি থাকবো না, এটাও কি হয়?❞ এমন একটি প্রবাদ অতিপ্রচলিত। টেলিছবিতে বলা যায় সাইমুমের সবাই অভিনয় করেছেন। হোক অভিনেতা, হোক শিল্পী, আর হোক তিনি সাধারণ সংস্কৃতিকর্মী। এতে পেশাদারিত্ব রক্ষিত হয়নি।
ঘ)সম্পাদনায় আরো একটু যত্নশীল হওয়া যেতো। বেশি বেশি ডিজলভ বিরক্তির কারণ ছিল। এমন প্রত্যেকটা ইফেক্টের আলাদা আলাদা অর্থ থাকে। কিন্তু এখানে অনর্থক ডিজলভ দেওয়া হয়েছে ম্যাচিং এর জন্য।
ঙ) মেকাপ। বিশেষ করে মকবুল চাচা এবং মোবাইল গানের ঘাতকের মেকাপ মেকাপের মতই হয়েছিল। বলা যায় বিগ বাজেটের কাজটি মেকাপে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে।
চ) ছবিতে বুঝানো হয়েছে গল্পের গ্রামের উপর দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে। একটা দুইটা শটের মধ্যেই এটা সীমাবদ্ধ থাকলে ভালো দেখাতো। কিন্তু রেল লাইন আর ট্রেনের ছুটে চলার বাহুল্য ব্যবহার এখানে স্পষ্ট। মিনিটে মিনিটে রেলের ছুটে চলার দৃশ্য ক্যাপচার করার লোভ চিত্রগ্রাহক সংবরণ করতে পারেননি।
ছ) সিনেমাটোগ্রাফি মোটামুটি ভালো ছিল। বিশেষ করে কিছু কিছু ফ্রেম অসাধারণ লেগেছে। রেল লাইনের ধার। পিছনে সূর্য উঠছে। মক্তবের শিক্ষার্থীরা মসজিদে যাচ্ছে। পাশ দিয়ে রেল ছুটে যাচ্ছে। আবার পিছনে রেল লাইনের ব্রীজ। রেল ছুটে চলছে একই সাথে অস্থির হাসান বাবার কবরের দিকে ছুটে যাচ্ছে। অথবা মধ্য রাতে বটগাছ তলায় মোমবাতি জ্বালানো পরিবেশ।
ভালো লাগার জায়গা:
ক) একজন নেশাখোর যখন হাসানকে পত্রিকায় দেখে বলে- চেহারাটা দেখছস নাকি। একদম গাঞ্জুইট্ট্যার মত দেখতে (অথচ ও নিজেই একজন গাঞ্জুইট্ট্যা।)
দ্বিতীয় হাসান ফেরত আসার সময় বলে- “কী ব্যবসায়ী তোমার কাছে আছে? শুকনা শাক আছে? গোডা গোডা আছে”?? এই ডাইলগগুলো হাস্যরস এবং একই সাথে হৃদয়বিদারকতা তৈরি করেছে।
খ) ফজরের আজান দিয়ে ছবির শুরু এবং সুর্যাস্ত দিয়ে ছবির সমাপ্তি।
শেষকথা: দের ঘন্টার একটি ছবি নির্মাণে সাইমুম টিম অনেক পরিশ্রম করেছে তা দেখেই বোঝা গেছে। সাইমুমকে অনুসরণ করে সারা বাংলাদেশের সংগঠনগুলো নাটক সিনেমা নির্মাণে এগিয়ে আসলে তাদের এই পরিশ্রম সার্থক হবে।
ধীরে ধীরে সাইমুম আরো পোক্ত হবে। নতুন নতুন কাজের আঞ্জাম দেবে এই প্রত্যাশা রাখাই যায়।

অফিশিয়াল পোস্টার

আপনার মূল্যবান রেটিং এবং মতামত দিতে পারেন IMDb তে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Ads

Ads