সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর শুরুর কথা!! (পর্ব-৩) | আবুল হোসাইন মাহমুদ



সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর শুরুর কথা!! (পর্ব-৩)
আবুল হোসাইন মাহমুদ

ঢাকার মোড়াপাড়া কলেজের অনুষ্ঠানটির কথা আবারও বলতে হচ্ছে। কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সংগঠনের প্যানেল জিতেছিল। তাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে উল্লেখিত শিল্পীরা গিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে শিল্পী হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন তোফাজ্জল হোসাইন খান। মতিউর রহমান মল্লিকের সাথে তার প্রথম পরিচয় হয় আগামসিহ লেনে সাইমুম প্রতিষ্ঠা হওয়ার বেশ আগেই। দায়িত্বশীল আবদুল্লাহর মাধ্যমে তাদের এই পরিচয় হয়েছিল। পরিচয়ের পর থেকেই শিল্পী হিসেবে মতিউর রহমান মল্লিক তাকে গানের ক্লাশগুলোতে রাখতেন।
আগামসিহ লেনের আগে ২২ প্রসন্ন পোদ্দার লেনের দোতলায় মতিউর রহমান মল্লিক থাকতেন। যেখানে দায়িত্বশীলদের মিলনকেন্দ্র ছিল । সেখানেও মতিউর রহমান মল্লিক দুয়েকজনকে নিয়ে গান গাইতেন। নিচতলায় থাকতেন মাস্টার শফিকুল্লাহ পরিবারসহ। তাঁর ছেলে তারিক মুনাওয়ার ও আকরাম মুজাহিদ। মুজাহিদ তখন হাফপেন্ট পরতো। সেই ছোট্ট মুজাহিদও মাঝে মধ্যে দোতলায় যেত। একদিন মতিউর রহমান মল্লিক তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন গান গাইতে পারে কিনা। মুজাহিদ তখন তার মায়ের কাছে শেখা একটি নজরুল সঙ্গীত শুনিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে হাফপ্যান্ট পরা মুজাহিদও শিল্পী। মতিউর রহমান মল্লিক এই মুজাহিদকে তখন ইনকিলাবের অস্ত্র মোদের লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ গানটি শিখিয়েছিলেন এবং তাকে ছোট খাটো অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য সাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যেতেন। তারিক মুনাওয়ার হোস্টেলে থাকতো। তামিরুল মিল্লাতের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিল। মাঝে মাঝে বাসায় এলে সেও মতিউর রহমান মল্লিকের গানের তালিমে শামিল হতো।
আগেই বলা হয়েছে মতিউর রহমান মল্লিক তখন গানের শিল্পী খোঁজার কাজে বেকারার ছিলেন। কাউকে গুনগুন করে গাইতে দেখলেই তিনি তার প্রতি আগ্রহী হতেন। তেমনি এক ঘটনায় পাওয়া যায় শিল্পী শহীদুল্লাহ মাসুদকে । সাইমুম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ৮০ সালের দিকে আলুবাজারের মেসে কিছুদিন থাকতেন শহীদুল্লাহ মাসুদ। সেখান থেকেই সাইমুমে নেয়া হয় শহীদল্লাহ মাসুদকে।
সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী নাম গৃহিত হওয়ার পর এর দায়িত্ব মূলতঃ মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুবের উপরই থাকলো। তার অঘোষিত সহকারী থাকলেন মতিউর রহমান মল্লিক। তখনো সাইমুম কোন উপশাখা হয়নি। ফলে সভাপতির কোন পদ হয়নি। সাইমুমের যারা শিল্পী তারা যে যে থানা-এলাকায় থাকতেন সে থানার তারা কর্মী ছিলেন। আর একমাত্র সাইমুমের কর্মী ছিলেন মতিউর রহমান মল্লিক । তার কাজ ছিল বিভিন্ন থানা থেকে শিল্পী সংগ্রহ ও গান শেখানো। তিনি বিভিন্ন প্রোগ্রাম উপলক্ষে শিল্পীদের সংগ্রহ করার জন্য নিজে বিভিন্ন থানার দায়িত্বশীলদের কাছে যেতেন । যোগাযোগ করতেন এবং এনে প্রশিক্ষণ দিয়ে অনুষ্ঠান করতেন।

প্রথমদিকে এককভাবে পরিবেশিত গান ভাল লাগলেও পরবর্তীতে শ্রোতারা এটাকে 
অন্যভাবে দেখলো। এরপর থেকে মতিউর রহমান মল্লিক সম্মিলিতভাবে গান গাওয়ার পরিকল্পনা নেন। সম্মিলিতভাবে গান গাওয়া খুব কঠিন কাজ। তাই তিনি ঠোঁট মিলানো পদ্ধতি চালু করেন। সম্মিলিত গানের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি খুবই উপযোগী। পরে মিউজিক কম্পোজারদের মত হাত নাড়িয়ে বা চিহ্ন ব্যবহার করার পদ্ধতি শুরু করেন।
যখন বিভিন্ন থানার কর্মী নিয়ে মতিউর রহমান মল্লিক কাজ শুরু করলেন তখন অনেকে প্রশ্ন তুললেন মূল সংগঠন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণ এ দুটিতে এক কর্মী কাজ করলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। এজন্য মতিউর রহমান মল্লিক ভাবলেন গান গাইতে হলে মেধাসম্পন্ন কর্মী দরকার। যেখানে একজন কর্মী মানগত দিক থেকে ভাল হবে এবং পড়াশোনার ক্ষেত্রে তার রেজাল্ট ভাল হবে। গান গাওয়ার সাথে সাথে যদি রেজাল্ট ভাল হয় তাহলে দায়িত্বশীলরা আপত্তি তুলতে পাববেনা -বরং খুশি হবে। এ জন্য দায়িত্বশীলদের বাড়ী থেকে শিল্পী সংগ্রহ করা দরকার। কারণ দায়িত্বশীলদের এটিও একটি ধারণা ছিল যে সাহিত্য সংস্কৃতিতে কাজ করলে কর্মীদের মান নষ্ট হয়ে যায়।
সেই সুবাদেই ইসলামী আন্দোলনের পরিবারগুলোকে তত্তাবধান করার সুযোগ পান মতিউর রহমান মল্লিক । সাইফুল আলম খান মিলনের মাধ্যমে সাইমুমে আনা হলো অধ্যাপক গোলাম আজম সাহেবের ছেলে নোমান আযমীকে। পরে সালমান আযমীকে। নোমান আজমীর মাধ্যমে আনা হয় সাইফুল্লাহ মানসুরকে। যাকে প্রথমে সুন্দর তিলাওয়াতের জন্য আনা হতো। অবশ্য এর আগে তেলাওয়াতের জন্য আনা হতো সাইফুল্লাহ হাম্মাদকে। তেমনি মাস্টার শফিকুল্লাহর ছেলে তারিক মুনাওয়ার ও মুজাহিদ এভাবেই আসে সাইমুমে । যদিও এরা দু’জন একেবারে ছোট থাকতেই মতিউর রহমান মল্লিকের স্নেহ-সান্নিধ্যে ছিল।
তেলাওয়াতের জন্য মাদরাসার ভাল ক্বারী ছাত্রদের সংগ্রহ করার পরিকল্পনা তখন করা হয়। কিন্তু পরে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে তা করা হয়েছে ।
যাহোক সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী গঠিত হবার দু’বছর পর মতিউর রহমান মল্লিকের উপর সাইমুমের দায়িত্ব আসে। অর্থাৎ মতিউর রহমান মল্লিক পরিচালক হন। এ সময় তিনি একটি শক্তিশালী টিম গঠন করে ফেলেন। সেই টিমই সাইমুমের মূল টিম। এই টিমকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মতিউর রহমান মল্লিক কয়েকটি সাড়া জাগানো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে ফেলেন। একটি ৮১ সালে রমনা গ্রীনের কর্মী সম্মেলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অপরটি ৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের অভিষেক অনুষ্ঠান। এ দুটি অনুষ্ঠান খুবই সফল হয়েছিল। ৮১ সম্মেলনে, মতিউর রহমান মল্লিক, রাশিদুল হাসান তপন, আবুল কাশেম, আকতার হোসেন, নোমান আযমী, তারেক মুনাওয়ার, জাহিদ, আমজাদসহ আরও অনেকেই হয়তো অংশ নিয়েছিলেন। যাদের সবার নাম এখানে বলা সম্ভব হচ্ছে না। সম্মেলনে গাওয়া এক‌টি সংগ্রামী গান " বজ্র আঘাতে ভাঙে একসাথে " মতিউর রহমান মল্লিকের লেখা যা রীতিমতো প্যারেড করে গাওয়া হয়েছিলো যার সার্বিক নির্দেশনায় ছিলেন বর্তমানে কানাডা প্রবাসী মাসুদ আলী । সম্মেলনের প্রশিক্ষণ হতো এলিফ্যান্ট রোডের আয়েশা একাডেমীতে। সম্মেলন সংগীত যেটি মতিউর রহমান মল্লিক লিখেছিলেন "সফল স্বার্থক হোক আমাদের কর্মী সম্মেলন " তার সুর তোফাজ্জল হোসাইন খানের এক‌টি দেশাত্মবোধক গান থেকে নিয়েছিলেন " স্বাধীন সার্বভৌম আমাদের সোনার বাংলাদেশ " অবশ্য তোফাজ্জল হোসাইন খানই মতিউর রহমান মল্লিককে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনের সময় সাইমুমের ইতিহাসে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। শিবিরের নির্বাচনী মিছিলে সাইমুমের পবিবেশিত গানের সময় দুর্বৃত্তদের মারাত্মক বোমা হামলার শিকার হয় সাইমুম। এতে সাইমুমের দুজন শিল্পী তোফাজ্জল হোসাইন খান ও সাইফ্ল্লুাহ আজীজের পা উড়ে যায়। এবং কিশোর মুজাহিদ মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয় । পরে এ কিশোর মুজাহিদই আকরাম মুজাহিদ নামে সাইমুমের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছিল।
১৯৮২ সাল পর্যন্ত মতিউর রহমান মল্লিক সাইমুমের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তখনো সাইমুম থানার মর্যাদা পায়নি।
প্রথম সাথী সম্মেলনে ‘শিবির সঙ্গীত গাওয়া হয়। এই সম্মেলনের পর সাইমুমের দেখাদেখি ডাঃ আকরাম যিনি ভাল নাটক লিখতেন - তার তত্তাবধানে ডাঃ সম রফিক চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন পাঞ্জেরী শিল্পী গোষ্ঠী। বরিশালে ডাঃ আবদুল জলিল এর উৎসাহে মহিউদ্দীন ‘হেরার রশ্মি শিল্পী গোষ্ঠী’ গঠন করেন।
এ সময়ে প্রথম নাটক হয়েছিল শায়েস্তা খান হলে। যার নাম ছিল ‘আগুনের ফুলকিরা । যেটি ডাঃ আকরাম করেছিলেন।
সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীর জন্য প্রথম ক্যাসেট প্লেয়ারটি দিয়েছিলেন আবুল কাশেম মিন্টু। ক্যাসেট প্লেয়ারটি খুবই দামী ছিল। উপরের অংশে ইকোলাইজেশন অপশন ছিল। এরও ছোট একটি ঘটনা আছে। পুরান ঢাকার গানের ক্লাশে মাঝে মধ্যে আবুল কাশেম মিন্টু উপস্থিত হতেন। সেখানে সেই ছোট্ট মুজাহিদের মাধ্যমে একটি ক্যাসেট প্লেয়ার এর কথা ওঠে এবং পরবর্তীতে আবুল কাশেম মিন্টু প্লেয়ারটি দেন। এটি দিয়ে সাইমুমের গানের ক্লাশ পরিচালনা ও সম্মিলিতভাবে করা সুর সংগ্রহ করা হতো। অর্থাৎ রেকর্ড করা হতো। সাইফুল আলম খান মিলন লন্ডনের সফরের সময় একটি দিয়েছিলেন। পরে মতিউর রহমান মল্লিক যখন ৮৫ তে লন্ডন সফরে যান তখন লন্ডনস্থ উত্তরণ শিল্পী গোষ্ঠী সাইমুমকে একটি ডবল ডেক কালো ক্যাসেট প্লেয়ার দিয়েছিল।

৮২ সালে সাইমুম থানা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। থানা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর এর সভাপতির দায়িত্ব পান আসাদ বিন হাফিজ। তিনি কাজ করতেন সাহিত্য বিভাগে। আগামসিহ লেনের অফিসে মতিউর রহমান মল্লিকের সাথে তার পরিচয় ঘটে। তবে গানের ব্যাপারে নয়। লেখালেখির ব্যাপারে। সাংগঠনিক প্রয়োজনে আসাদ বিন হাফিজকে সাইমুমের সভাপতি করা হয়। কারণ আসাদ বিন হাফিজ শিল্পী ছিলেন না। কবি ছিলেন । তারপরও সংগঠন প্রয়োজন মনে করে তাকে এ দায়িত্ব দেয়। যদিও দায়িত্বশীল আসাদ বিন হাফিজ, তবু মূল তত্তাবধানে থাকেন মতিউর রহমান মল্লিক। গানের ক্লাশ ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ মতিউর রহমান মল্লিক দেখশোনা করতেন। আর আসাদ বিন হাফিজ উপশাখা দেখাশোনা ও ব্যবস্থাপনার কাজ করতেন। এ সময়ে সাইমুম অফিস, আলমারি, স্কুল ইউনিট, ইত্যাদি হয়। পরিকল্পনা করা হয় সাংস্কৃতিক অনষ্ঠানের।এ সময়ে দুটি বিশাল অনুষ্ঠান হয়। একটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সীরাতুন্নবীর অনুষ্ঠান। অপরটি জামাতের ইঞ্জিনিয়ার ইনষ্টিটিউট হলের প্রোগ্রাম। প্রথম অনুষ্ঠানটিকে সাইমুমের ইতিহাসে সবচে বড় ও সফল অনুষ্ঠান হিসেবে গন্য করা হয়। এতে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা অংশ নিয়েছিল। তখন পত্র-পত্রিকায় বিশেষ করে সংগ্রাম ও সোনার বাংলায় সাইমুম সম্পর্কে বেশ চিঠি এসেছিল এই আহবান জানিয়ে যে, সাইমুমের গান রেডিও টিভিতে প্রচার করা হোক। এর পরে আরো কিছু সফল প্রোগ্রাম হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে ৮৫ সালে মানিক মিয়া এভিনিউতে সিরাত মহাসম্মেলনের পরিবেশনার কথা বলা যায়। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তা সংক্ষেপ করা হয়েছিল। আর ৮৭ সালের সাথী সম্মেলনের গীতি আলেখ্যের কথা তো ভোলার মতো নয়। রাশিদুল হাসান তপনের সেই হৃদয় উজাড় করা উপস্থাপনা আজো মনে পড়ে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Ads

Ads